সহজ উমরা নির্দেশিকা

সহজ উমরা নির্দেশিকা
সংকলনঃ মুহা: আবদুল্লাহ্‌ আল কাফী
দাঈ, জুবাইল দাওয়া এন্ড গাইডেন্স সেন্টার, সঊদী আরব।
▬▬▬✪✪✪▬▬▬

بسم الله الرحمن الرحيم

ওমরাহ্‌ একটি অন্যতম গুরুত্বপূর্ণ ইবাদত। যা আত্মিক, মৌখিক, দৈহিক ও আর্থিক ত্যাগ সমম্বয়ে গঠিত। প্রতিটি সামর্থবান ব্যক্তির উপর উহা পালন করা অবশ্যকর্তব্য। রাসূলুল্লাহ্‌ সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়া সাল্লাম বলেন: এক ওমরা থেকে অপর ওমরা উভয়ের মধ্যবর্তী পাপের কাফ্‌ফারা স্বরূপ। (বুখারী ও মুসলিম)
তিনি আরো বলেন: যে ব্যক্তি (হজ্জ ওমরা করার জন্য) এঘরে আসবে, অত:পর স্ত্রী সহবাসে লিপ্ত হবে না এবং পাপাচারে লিপ্ত হবে না, সে এমন (নিষ্পাপ) অবস্থায় প্রত্যাবর্তন করবে যেমন তার মাতা তাকে ভুমিষ্ট করেছিল। (মুসলিম) এই গুরুত্বপূর্ণ ইবাদতটি বিশুদ্ধভাবে আদায়ের চেষ্টা করা একান- ভাবে অপরিহার্য।

এ লক্ষ্যে কুরআন-হাদীছের নির্যাস নিন্ম লিখিত সংক্ষিপ্ত বিষয়গুলি সকলের জন্য অনুসরণীয়:

🔰একনিষ্ঠতার সাথে শুধুমাত্র আল্লাহ্‌কে রাযী-খুশী করার জন্য ওমরা পালন করা।
🔰উহা পালনের ক্ষেত্রে শুধুমাত্র রাসূলুল্লাহ ছাল্লাল্লাহু আলাইহে ওয়া সাল্লামের তরীকা ও পদ্ধতি অনুসরণ করা।
🔰হালাল বা বৈধ উপার্জন থেকে ওমরা পালন করা।
🔰ওমরার বিধান সমপর্কে প্রয়োজনীয় জ্ঞানার্জন করা।
🔰পাঁচ ওয়াক্ত ছালাত সঠিকভাবে আদায় করা। কেননা ছালাত আদায় না করলে ওমরা করে কোন লাভ নেই।
🔰যাবতীয় শির্‌ক, বিদআত ও পাপাচার থেকে বিরত থাকা।


ওমরাহ্‌র কাজগুলি ধারাবাহিকভাবে নিন্মরূপ:

 ইহরামের পূর্বে শারীরিকভাবে পরিচ্ছন্নতা অর্জন করা তথা- নাভীমূল, বগলের লোম পরিস্কার করা, নখ কাটা।
📌মীক্বাত থেকে ইহ্‌রাম বাঁধা। (ওয়াজিব)
🚿মীকাতে গিয়ে ইহরামের উদ্দেশ্যে প্রথমে গোসল করা।
🏺সম্ভব হলে মাথা, দাড়ি বা শরীরে আতর-সুগন্ধি ব্যবহার করা।
🖱🖱সেলাই বিহীন দুটি কাপড়ে ইহ্‌রাম বাঁধা। (শুধু পূরুষদের জন্য) নারীরা যে কোন কাপড়ে ইহরাম করতে পারে। তাদের জন্য সাদা কাপড় বা বোরখা পরিধান করা আবশ্যক নয়।)
👉কাপড় দুটি সাদা হওয়া উত্তম। একটি লুংঙ্গি অপরটি চাদর হিসেবে।
👉ওমরার উদ্দেশ্যে (অন্তরে) নিয়ত করে ইহ্‌রাম বাঁধা। (রুকন)
👉 ইহ্‌রাম বাঁধার সময় বলবেঃ
আল্লাহুম্মা লাব্বাইকা উমরাতান।
👉রাসূলুল্লাহ্‌ ছাল্লাল্লাহু আলাইহে ওয়া সাল্লামের পঠিত তালবিয়া জোরে জোরে পাঠ করা।
তালবিয়াঃ
(لَبَّيْكَ اللَّهُمَّ لَبَّيْكَ، لَبَّيْكَ لاَ شَرِيْكَ لَكَ لَبَّيْكَ، إنَّ الْحَمْدَ وَالنِّعْمَةَ لَكَ وَالْمُلْكَ، لاَ شَرِيْكَ لَكَ) ‘
লাব্বাইকা আল্লাহুম্মা লাব্বাইকা, লাব্বাইকা লা-শারীকা লাকা লাব্বাইকা, ইন্নাল হামদা ওয়ান্‌ না’মাতা লাকা ওয়াল্‌ মুল্‌ক্‌, লা-শারীকা লাক।
👉 মক্কা পর্যন্ত সারা রাস্তা এই তালবিয়া বেশী করে পাঠ করবে এবং অন্যান্য তাসবীহ তাহলীলেও লিপ্ত থাকবে।
🕋 মক্কায় গিয়ে অজু করে (সম্ভব হলে গোসল করে) পবিত্রতার সাথে মসজিদুল হারামে প্রবেশ করা। (তওয়াফের জন্য পবিত্রতা আবশ্যক)
🕋 মসজিদে হারামে প্রবেশের পূর্বে তালবিয়া বলা বন্ধ করা।
🕋 তাওয়াফের জন্য সরাসরি হজরে আসওয়াদের দিকে এগিয়ে যাওয়া।
🕋 তাওয়াফ শুরুর পূর্বে ইযতিবা করা। (ইহরামের কাপড় ডান বগলের নীচ দিয়ে নিয়ে বাম কাঁধের উপর রাখা) নামাযের সময় উভয় কাঁধ ঢেকে রাখা জরুরী।
🕋 ‘বিসমিল্লাহি আল্লাহু আক্‌বার’ বলে হজরে আসওয়াদকে চুম্বন করে বা ইশারা করে তওয়াফ শুরু করা।
🕋 প্রথম তিন চক্করে রম করা। (ছোট ছোট কদমে দ্রুত চলা)
🕋 তাওয়াফ অবস্থায় কোন দুআ নির্দিষ্ট না করে যে কোন দুআ যিকির পাঠ করা।
🕋 আল্লাহ্‌র ঘর বাম দিকে রেখে তওয়াফ করা।
🕋 হাতিমের বাহির দিয়ে তওয়াফ করা।
🕋 রোক্‌নে ইয়ামানী সপর্শ করা। তা না পারলে ইঙ্গিত না করেই চলতে থাকা।
🕋রোকনে ইয়ামানী এবং হজরে আসওয়াদের মধ্যবর্তী স্থানে এই দোয়া পড়াঃ
رَبَّنَا آتِنَا فِي الدُّنْيَا حَسَنَةً وَفِي الْآخِرَةِ حَسَنَةً وَقِنَا عَذَابَ النَّارِ “রাব্বানা আতিনা ফিদ্দুনিয়া হাসানাতাঁও ওয়া ফিল আখিরাতি হাসানাতাঁও ওয়া ক্কিনা আযাবান্নার।”
🕋একাধারে সাত চক্কর পূর্ণ করা। (রুকন)
🕋 মাকামে ইবরাহীমের পিছনে ২ রাকাআত নামায পড়া। (সেখানে সম্ভব না হলে মসজিদুল হারামের যে কোন স’ানে তা আদায় করা।)
🕋 সূরা ফাতিহার পর প্রথম রাকাআতে সূরা কাফেরূন এবং দ্বিতীয় রাকাআতে সূরা ইখলাছ পড়া।
🕋 যম্‌যম্‌ এর পানি পান করা এবং উহা মাথায় ঢালা।
🕋 আবার হজরে আসওয়াদে চুম্বন দেয়া বা ইঙ্গিত করা।

إِنَّ الصَّفَا وَالْمَرْوَةَ مِنْ شَعَائِرِ اللَّهِ “ইন্নাছ্‌ছাফা ওয়াল মার্‌ওয়াতা মিন শাআয়িরিল্লাহি বলতে বলতে সাফা পাহাড়ে আরোহণ করা।
ক্বিবলামুখি হয়ে দাঁড়িয়ে তাওহীদ, তাক্‌বীর, তাহমীদ ইত্যাদি পাঠ করা। অতঃপর তিনবার বলবে: (لاَ إلَهَ إلاَّ اللهُ وَحْدَهُ لاَشَرِيْكَ لَهُ، لَهُ الْمُلْكُ وَلَهُ الْحَمْدُ يُحْيِيْ وَيُمِيْتُ وَهُوَ عَلىَ كُلِّ شَيْءٍ قَدِيْرٌ . لاَ إلَهَ إلاَّ اللهُ وَحْدَهُ أنْجَزَ وَعْدَهُ وَنَصَرَ عَبْدَهُ وهَزَمَ الأحْزاَبَ وَحْدَهُ.) এরপর জানা যে কোন দুআ পাঠ করবে।
সবুজ বাতিদ্বয়ের মধ্যবর্তী অংশে দৌড়ানো। (মহিলারা দৌড়াবে না।)
👉ছাফা-মারওয়া সাঈ করার সময় কোন দোয়া নির্দিষ্ট না করে, জানা যে কোন দুআ পড়া।
🗻 মারওয়া পাহাড়ে আরোহণ করা।
🏔 সেখানেও ছাফা পাহাড়ের ন্যায় দুআ করা।
🗻 সাত বার ছাফা-মারওয়া সাঈ করা। (রুকন)
👉 ছাফা থেকে মারওয়া গমণ ১ম চক্কর, মারওয়া থেকে ছাফা প্রত্যাবর্তন ২য় চক্কর। এভাবে ৭ম চক্কর মারওয়ায় এসে শেষ করা।
মাথার চুল মুড়িয়ে বা খাটো করে হালাল হয়ে যাওয়া। (ওয়াজিব)

কতিপয় ভুলত্রুটি

অনেকে ইহরাম বাঁধার সময় থেকেই ইযতেবা তথা (ইহরামের কাপড় ডান বগলের নীচ দিয়ে নিয়ে বাম কাধের উপর রেখে দেয়, এমনকি ছালাতের সময়ও সেভাবেই থাকে। এরূপ করা সুন্নাতের পরিপন্থী। ইযতেবা শুধু তওয়াফের মূহুর্তে করা সুন্নাত, অন্য সময় নয়।অনেকে ইহরাম বাঁধার উদ্দেশ্যে রাকাআত ছালাত আদায় করে থাকে। মূলত: ইহরামের জন্য কোন ছালাত নেই। তবে কোন ফরয ছালাতের সময় হয়ে গেলে, উক্ত ছালাত আদায় করার পর ইহরাম বাঁধবে।
কাবা ঘরের তওয়াফ এবং ছাফা-মারওয়া সাঈ করার জন্য নির্দিষ্ট কোন দুআ হাদীছ দ্বারা প্রমাণিত নয়। এসময় অনির্দিষ্টভাবে যে কোনদুয়া বা প্রার্থনা যে কোন ভাষায় করা যাবে। সুতরাং বিভিন্ন ধরনের কিতাবে যে সকল দুয়া লিখিত আছে- ১ম চক্করের দুআ……. ২য় চক্করের দুয়া………. তা নি:সন্দেহে ভুল। কেননা এভাবে নির্দিষ্ট চক্করের জন্য নির্দিষ্ট দুআ না রাসূলুল্লাহ্‌ (ছাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়া সাল্লাম) পড়েছেন না তিনি পড়তে বলেছেন, না কোন ছাহাবী (রা:) এরূপ করেছেন।
 হজরে আসওয়াদকে চুম্বন করা যরূরী মনে করে মানুষকে কষ্ট দেয়া বৈধ নয়। কেননা একে চুম্বন করা সুন্নাত, কিন’ মানুষকে কষ্ট দেয়া হারাম।
তওয়াফ-সাঈর সময় সশব্দে দুআ পড়া সুন্নাতের খেলাফ ও অন্যায় কাজ।
অনেকে ছাফা-মারওয়া সাঈ শেষে মাথার বিভিন্ন দিক থেকে অল্প অল্প করে চুল কাটে। এটা কখনই বৈধ নয়। কেননা সম্পূর্ণ মাথা থেকেই চুল কাটতে হবে। যেমনটি সম্পূর্ণ মাথার চুলই মুণ্ডন করতে হয়।
 তানঈম বা মসজিদে আয়েশা বা ওমরাহ্‌ মসজিদ থেকে ঘন ঘন ইহরাম বেঁধে এসে নিজের জন্য বা আত্মীয়-স্বজনের নামে ওমরাহ্‌ পালন করা বিধি সম্মত নয়। কেননা, একই সফরে এরূপ একাধিক ওমরাহ্‌ করা রাসুলুল্লাহ্‌ ছাল্লাল্লাহু আলাইহে ওয়া সাল্লাম, তাঁর সাহাবায়ে কেরাম (রাঃ) ও তাবেঈদের কারো থেকে সাব্যস- নেই। (বিস্তারিত দেখুন আল-মুগনী ৫/১৭)

মসজিদে নববীর যিয়ারত:

উহা মুস্তাহাব। সুন্নাতে মুআক্বাদাহ্‌ নয় বা ওয়াজিব ফরযও নয়। আর উহা যিয়ারত করা হজ্জ্ব ওমরাহ্‌র সামান্যতম অংশ বিশেষও নয়। সুতরাং শুধুমাত্র মদীনার মসজিদে ইবাদতের উদ্দেশ্যে সফর জায়েয (বৈধ)। অন্য কোন উদ্দেশ্যে (যেমন- নবী ছাল্লাল্লাহু আলাইহে ওয়া সাল্লামের এর মাজার যিয়ারত বা সাহাবার (রাঃ) কবর যিয়ারত ইত্যাদি) সফর করা জায়েয নয়। তবে মসজিদে নববী পৌঁছার পর উক্ত স্তান সমূহ যিয়ারত করতে কোন বাধা নেই। (বুখারী ও মুসলিম)

ওমরাহ্‌র রুকন ৩টি:

১) ইহরাম বাঁধা।
২) তাওয়াফ করা।
৩) সাঈ করা।

ওমরাহ্‌র ওয়াজিব ২টি :

১) মীকাত হতে ইহরাম বাঁধা।
২) চুল কামানো বা ছোট করা।

ইহরাম অবস্থায় যা করা নিষিদ্ধ:

🚫সেলাইকৃত কাপড় পরা।
🚫 মুখ ঢাঁকা।
🚫পুরুষদের মাথা ঢাকা।
🚫 হাতমোজা পরিধান করা।
🚫নোখ, চুল ইত্যাদি কাটা।
🚫স্থলচর প্রাণী শিকার করা বা তা শিকার করার জন্য ইঙ্গিত করা। স্ত্রী সহবাস করা।
🚫কোন জিনিস কুড়ানো (হারাম এলাকায়)।
🚫বিয়ে করা বা বিয়ের প্রস্তাব দেওয়া।
🚫সুগন্ধি ব্যবহার করা

ওমরা ফরয হওয়ার শর্তাবলী:

১) ইসলাম (সুরা তাওবাহ্‌ঃ ৫৪)
২) জ্ঞান সমপন্ন হওয়া
৩) স্বাধীন হওয়া। (আহমাদ, আবু দাউদ, নাসায়ী)
৪) বালেগ হওয়া। (আহমাদ, আবু দাউদ, নাসায়ী)
৫) অর্থিক ও শারীরিক ক্ষমতা সমপন্ন হওয়া। (আল ইমরানঃ ৯৭)
৬) মহিলার জন্য স্বামী অথবা মাহরাম থাকা। (বুখারী ও মুসলিম)

বিশেষ দ্রষ্টব্য:

 ওমরার কোন একটি রুকন ছুটে গেলে ওমরা বাতিল হয়ে যাবে।
 আর কোন একটি ওয়াজিব ছুটে গেলে কাফ্‌ফারা দিতে হবে।

মহান আল্লাহ্‌ আমাদেরকে পবিত্র কুরআন এবং সহীহ্‌ হাদীস অনুযায়ী ওমরা পালন করে সৌভাগ্যশালীদের অন্তর্ভূক্ত করুন। আমীন!!