যাদের দেশে দিন বড় হয় অথবা সূর্য অস্ত যায় না তারা কিভাবে নামায ও রোজা পালন করবে

প্রশ্ন: যাদের অঞ্চলে দিন ২১ ঘণ্টা দীর্ঘ হয় তারা কি করবে? তারা কি রোজার জন্য বিশেষ কোন হিসাব করে নিবে? যাদের অঞ্চলে দিন খুব ছোট তারা কি করবে? একইভাবে যাদের অঞ্চলে ৬ মাস দিন ও ৬ মাস রাত থাকে তারা কি করবে? তারা কিভাবে নামায ও রোজা আদায় করবে?

উত্তর:
আলহামদুলিল্লাহ।
যাদের অঞ্চলে ২৪ ঘণ্টার পরিসরে রাতদিন হয় তারা দিবাভাগে রোজা পালন করবে। দিবাভাগ ছোট হোক কিংবা বড় হোক। আলহামদুলিল্লাহ, দিবাভাগ ছোট হলেও সে ভাগে রোজা রাখা তাদের জন্য যথেষ্ট। পক্ষান্তরে যাদের দিনরাত ২৪ ঘণ্টার চেয়ে দীর্ঘ হয় যেমন– ৬ মাস তারা নামায ও রোযার জন্য একটি সময়সূচী নির্ধারণ করে নিবে। যেভাবে নবী সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়া সাল্লাম দাজ্জাল আবির্ভূত হওয়ার দিনের ব্যাপারে একটি সময়সূচী নির্ধারণ করে নেয়ার আদেশ করেছেন। যে দিন হবে ১ বছরের সমান অথবা ১ মাসের সমান কিংবা ১ সপ্তাহের সমান।

সৌদি উচ্চ উলামা পরিষদ এই মাসয়ালাটি গবেষণা করে একটি সিদ্ধান্ত প্রকাশ করেছেন; নং- ৬১ তারিখ- ১২/৪/১৩৯৮ হিজরী। উক্ত সিদ্ধান্তটি নিম্নরূপ:

সমস্ত প্রশংসা আল্লাহ তাআলার জন্য। রহমত ও শান্তি বর্ষিত হোক আল্লাহর রাসূলের প্রতি, তাঁর পরিবারবর্গ ও সাহাবীগনের প্রতি।

এক:
কেউ যদি এমন কোন দেশে অবস্থান করে যেখানে সূর্যোদয় ও সূর্যাস্তের মাধ্যমে দিন ও রাত চিহ্নিত করা যায় এবং গ্রীষ্মের দিন খুব বড় ও শীতের দিন ছোট হয় তবে শরিয়ত কর্তৃক নির্ধারিত সুবিদিত ৫ ওয়াক্ত সময়সূচী অনুযায়ী নামায আদায় করা তাদের জন্য ফরজ। এর দলিল হচ্ছে- আল্লাহ তাআলার বাণী:

(أَقِمْ الصَّلَاةَ لِدُلُوكِ الشَّمْسِ إِلَى غَسَقِ اللَّيْلِ وَقُرْآنَ الْفَجْرِ إِنَّ قُرْآنَ الْفَجْرِ كَانَ مَشْهُودًا) [17 الإسراء : 78]

“সূর্য ঢলে পড়ার পর থেকে রাতের অন্ধকার ঘন হওয়া পর্যন্ত এবং ফজরের নামায কায়েম করুন। নিশ্চয় ফজরের তেলাওয়াতে (ফেরেশতারা) উপস্থিত থাকে।” [১৭ সূরা আল ইস্‌রা: ৭৮]

আল্লাহ তাআলা আরও বলেন:

(إِنَّ الصَّلَاةَ كَانَتْ عَلَى الْمُؤْمِنِينَ كِتَابًا مَوْقُوتًا)  [4 النساء : 103]

“নিশ্চয় সালাত নির্ধারিত সময়ে আদায় করা মুমিনদের উপর ফরজ।”[ ৪ সূরা আল নিসা: ১০৩]

আব্দুল্লাহ ইবনে আমর ইবনে আস রাদিয়াল্লাহু আনহুমা থেকে প্রমাণিত হয়েছে যে, নবী সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়া সাল্লাম বলেছেন:

(وَقْتُ الظُّهْرِ إِذَا زَالَتْ الشَّمْسُ وَكَانَ ظِلُّ الرَّجُلِ كَطُولِهِ مَا لَمْ يَحْضُرْ الْعَصْرُ ، وَوَقْتُ الْعَصْرِ مَا لَمْ تَصْفَرَّ الشَّمْسُ ، وَوَقْتُ صَلَاةِ الْمَغْرِبِ مَا لَمْ يَغِبْ الشَّفَقُ ، وَوَقْتُ صَلَاةِ الْعِشَاءِ إِلَى نِصْفِ اللَّيْلِ الْأَوْسَطِ ، وَوَقْتُ صَلَاةِ الصُّبْحِ مِنْ طُلُوعِ الْفَجْرِ مَا لَمْ تَطْلُعْ الشَّمْسُ ، فَإِذَا طَلَعَتْ الشَّمْسُ فَأَمْسِكْ عَنْ الصَّلَاةِ فَإِنَّهَا تَطْلُعُ بَيْنَ قَرْنَيْ شَيْطَانٍ) رواه مسلم (612)

“জোহরের সময় হলো- যখন সূর্য পশ্চিমাকাশে হেলে পড়ে তখন থেকে শুরু করে ব্যক্তির ছায়া তার সমপরিমাণ হয়ে আসরের ওয়াক্ত না-আসা পর্যন্ত। আসরের সময় হলো- যতক্ষণ না সূর্য হলুদ বর্ণ ধারণ করে। মাগরিবের সময় হলো- যতক্ষণ না পশ্চিমাকাশের লালিমা অদৃশ্য হয়ে যায়। এশার সময় হলো মধ্যরাত্রি পর্যন্ত। ফজরের সময় প্রভাতের আলো বিচ্ছুরিত হওয়া থেকে শুরু করে সূর্য উদিত হওয়া পর্যন্ত। সূর্যোদয়কালীন সময়ে নামায থেকে বিরত থাকুন। কেননা, সূর্য শয়তানের দুই শিংয়ের মাঝখানে উদিত হয়।” [মুসলিম ৬১২]

এছাড়াও পাঁচ ওয়াক্ত নামাযের সময়সীমা নির্ধারণমূলক আরও অনেক কওলি ও ফেলি হাদিস রয়েছে। এ হাদিসগুলোতে দিন ছোট কি বড় সে পার্থক্য করা হয়নি। রাত ছোট কি বড় সে পার্থক্য করা হয়নি। যেহেতু রাসূলুল্লাহ সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়া সাল্লাম নির্দিষ্ট আলামতের মাধ্যমে নামাযের সময়সীমা আলাদাভাবে চিহ্নিত করে দিয়েছেন। নামাযের সময়সূচী সম্পর্কে এই আলোচনা।

আর রমজানের রোজা রাখার সময়সীমা নির্ধারণের ক্ষেত্রে মুকাল্লাফ (শরয়ি ভারপ্রাপ্ত) ব্যক্তিদের ওয়াজিব হলো- তাদের দেশে ফজরের শুরু থেকে সূর্যাস্ত পর্যন্ত সময়ে খাবার, পানীয় ও সকল প্রকার রোজা-ভঙ্গকারী মুফাত্তিরাত থেকে বিরত থাকা; যে পর্যন্ত তাদের দেশে রাত থেকে দিনকে পৃথকভাবে আলাদা করা যায় এবং রাতদিনের পরিসীমা ২৪ ঘণ্টায় হয়ে থাকে। রাত ছোট হলেও তাদের জন্য খাবার, পানীয় ও শারীরিক মিলন ইত্যাদি শুধু রাতের বেলায় হালাল হবে। কারণ ইসলামী শরিয়ত সকল দেশের মানুষের জন্য সমানভাবে প্রযোজ্য। আল্লাহ বলেন:

(وَكُلُوا وَاشْرَبُوا حَتَّى يَتَبَيَّنَ لَكُمْ الْخَيْطُ الْأَبْيَضُ مِنْ الْخَيْطِ الْأَسْوَدِ مِنْ الْفَجْرِ ثُمَّ أَتِمُّوا الصِّيَامَ إِلَى اللَّيْلِ) [2 البقرة : 187]

আর তোমরা পানাহার কর যতক্ষণ না ঊষার কালো সুতা হতে ঊষার সাদা সুতা স্পষ্টরূপে তোমাদের নিকট প্রতিভাত হয়। অতঃপর রাত্রি পর্যন্ত সিয়াম পূর্ণ কর” [সূরা বাকারাহ, ২ : ১৮৭]

যে ব্যক্তি রোজা সম্পন্ন করতে ব্যর্থ হবে দিন দীর্ঘ হওয়ার কারণে কিংবা বিভিন্ন আলামত, অভিজ্ঞতা, বিশ্বস্ত ও বিশেষজ্ঞ চিকিৎসকের পরামর্শের ভিত্তিতে জানতে পারবে নতুবা তার প্রবল ধারণা হবে যে, এই রোজা পালনের কারণে তার মৃত্যু হতে পারে অথবা কঠিন রোগ দেখা দিতে পারে অথবা বর্তমান রোগ বেড়ে যেতে পারে অথবা সুস্থতা বিলম্বিত হতে পারে তবে সেক্ষেত্রে তিনি রোজা না-রেখে সেই দিনগুলোর কাযা রোজা সুবিধা মত সময়ে পালন করবেন। আল্লাহ তাআলা বলেন:

(فَمَنْ شَهِدَ مِنْكُمْ الشَّهْرَ فَلْيَصُمْهُ وَمَنْ كَانَ مَرِيضًا أَوْ عَلَى سَفَرٍ فَعِدَّةٌ مِنْ أَيَّامٍ أُخَرَ) [2 البقرة : 185]

“তোমাদের মধ্যে যে ব্যক্তি এই মাস পেল সে যেন এই মাসে সিয়াম পালন করে। আর কেউ অসুস্থ থাকলে কিংবা সফরে থাকলে সে অন্য সময়ে এই সংখ্যা পূরণ করবে।” [২ সূরা আল-বাক্বারাহ: ১৮৫]

আল্লাহ তাআলা আরও বলেন:

(لَا يُكَلِّفُ اللَّهُ نَفْسًا إِلَّا وُسْعَهَا) [2 البقرة : 286]

“আল্লাহ যে কারো উপর তার সাধ্যের মধ্যে ভার আরোপ করেন।” [২ সূরা আল-বাক্বারা: ২৮৬]

আল্লাহ তাআলা আরও বলেছেন:

(وَمَا جَعَلَ عَلَيْكُمْ فِي الدِّينِ مِنْ حَرَجٍ) [22 الحج : 78]

“তিনি তোমাদের উপর দ্বীন পালনে কাঠিন্য আরোপ করেন নি।” [২২ সূরা আল-হজ্জ : ৭৮]

দুই:
কেউ যদি এমন কোন দেশে অবস্থান করে যেখানে গ্রীষ্মকালে সূর্য ডুবে না অথবা শীতকালে সূর্য উদিত হয় না অথবা দিবালোক ৬ মাস ও রাতের অন্ধকার ৬ মাস স্থায়ী হয় তবে তাদের জন্য প্রতি ২৪ ঘণ্টায় ৫ বার সালাত আদায় করা ফরজ এবং নিকটবর্তী দেশের নামাযের সময়সূচী অনুযায়ী তারা একটি সময়সূচী নির্ধারণ করে নিবে। নিকটবর্তী যে দেশে নামাযের সময়গুলো একটি থেকে আরেকটি আলাদাভাবে চিহ্নিত করা যায়। এর দলিল হচ্ছে- ইসরা ও মিরাজের হাদিসে সাব্যস্ত হয়েছে আল্লাহ তাআলা এই উম্মতের উপর দিবানিশি ৫০ ওয়াক্ত নামায ফরজ করেছিলেন। নবী সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়া সাল্লাম তাঁর রবের নিকট তা কমানোর প্রার্থনা করতে থাকলেন, এক পর্যায়ে আল্লাহ বললেন:

(يَا مُحَمَّدُ ، إِنَّهُنَّ خَمْسُ صَلَوَاتٍ كُلَّ يَوْمٍ وَلَيْلَةٍ) رواه مسلم (162) .

“হে মুহাম্মদ! নিশ্চয় (ফরজকৃত নামায) প্রতিদিন ও রাতে ৫ বার নামায।”[ সহিহ মুসলিম (১৬২)]

আরও দলিল হচ্ছে– ত্বালহা ইবনে উবাইদুল্লাহ রাদিয়াল্লাহু আনহু থেকে প্রমাণিত হয়েছে যে, তিনি বলেন: “রাসূলুল্লাহ সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়া সাল্লাম এর কাছে নজদ থেকে এক লোক এলো। তার চুল ছিল এলোমেলো। আমরা তার গুনগুন শব্দ শুনছিলাম; কিন্তু সে কি বলছে তা বুঝা যাচ্ছিল না। এক পর্যায়ে সে রাসূলুল্লাহ সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়া সাল্লাম এর কাছে এলো এবং ইসলাম সম্পর্কে প্রশ্ন করল। উত্তরে রাসূলুল্লাহ সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়া সাল্লাম বললেন: “দিনে ও রাতে ৫ বার নামায আদায় করা।” সে বলল: “আমার উপর কি এগুলো ছাড়া আর কোন নামাযের দায়িত্ব আছে?” তিনি বললেন: “না, তবে আপনি যদি নফল নামায করতে চান…।”[সহিহ বুখারী (৪৬) ও সহিহ মুসলিম (১১)]

এছাড়াও সাব্যস্ত আছে যে, নবী সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়া সাল্লাম তাঁর সাহাবীদের নিকট মসীহ দাজ্জাল সম্পর্কে আলোচনা করছিলেন। তখন সাহাবীগণ বললেন: “সে পৃথিবীতে কতদিন থাকবে?” তিনি বললেন: “চল্লিশ দিন। তার একটা দিন হবে এক বছরের সমান। একটা দিন হবে এক মাসের সমান। একটা দিন হবে এক সপ্তাহের সমান। আর বাকি দিনগুলো আপনাদের দিনের মত হবে।” আমরা বললাম: “ইয়া রাসূলুল্লাহ! তার যে দিনটি এক বছরের সমান হবে সে দিনে কী শুধু একদিনের সালাত আদায় করলে যথেষ্ট হবে?” তিনি বললেন: “না, আপনাদেরকে হিসাব করে নিতে হবে।”[সহিহ মুসলিম (২৯৩৭)]

সুতরাং যে দিনের দৈর্ঘ্য একবছরের সমান সেদিনে শুধু ৫ বার নামায আদায় করাকে নবী সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়া সাল্লাম যথেষ্ট ঘোষণা করেন নি। বরং সে দিনের প্রতি ২৪ ঘণ্টায় ৫ বার নামায আদায় করা ফরজ করেছেন এবং তাদের দেশের স্বাভাবিক দিনে এক ওয়াক্ত থেকে আরেক ওয়াক্তের মাঝে যে ব্যবধান থাকে সেটাকে ভিত্তি করে নামাযের সময়সূচী নির্ধারণ করে নেয়ার নির্দেশ দিয়েছেন। সুতরাং যে দেশের নামাযের সময়সূচী নির্ধারণ সম্পর্কে প্রশ্ন করা হয়েছে, সে দেশের মুসলিমদের উপর ওয়াজিব হল- তারা তাদের সবচেয়ে নিকটবর্তী যে দেশে রাত ও দিন আলাদাভাবে চিহ্নিত করা যায়, যে দেশে শরিয়ত নির্ধারিত আলামতগুলোর ভিত্তিতে প্রতি ২৪ ঘণ্টায় ৫ ওয়াক্ব্ত নামাযের সময়সূচী নির্ণয় করা যায় সে দেশের সময়সূচীর উপর ভিত্তি করে তাদের নামাযের সময় নির্ধারণ করে নিবে। অনুরূপভাবে তাদের উপর রমজান মাসের সিয়াম পালন ফরজ। তারা তাদের সিয়াম পালনের জন্য রমজান মাসের শুরু ও শেষ নির্ধারণ করবে, রমজান মাসের প্রতিদিন রোজা শুরুর সময় ও ইফতারের সময় নির্ধারণ করবে তাদের সবচেয়ে কাছের যে দেশে স্বাভাবিক ২৪ ঘণ্টায় দিন-রাত পৃথকভাবে চিহ্নিত করা যায় সে দেশের ফজরের সময় ও সূর্যাস্তের সময়ের ভিত্তিতে। এই দিনের সময়সীমা হবে ২৪ ঘণ্টা। এর দলিল হচ্ছে- ইতিপূর্বে উল্লেখিত মসিহ দাজ্জাল সম্পর্কিত নবী সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়া সাল্লামের হাদিস। যে হাদিসে নবী সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়া সাল্লাম তাঁর সাহাবীগণকে নামাযের সময় নির্ধারণ পদ্ধতি সম্পর্কে দিকনির্দেশনা দিয়েছেন। এ ক্ষেত্রে রোজা ও নামাযের মাসয়ালার মধ্যে কোন পার্থক্য নেই।

আল্লাহই তাওফিক দাতা। আল্লাহ আমাদের নবী মুহাম্মদ, তাঁর পরিবারবর্গ ও তাঁর সাহাবীগণের উপর আল্লাহর পক্ষ থেকে রহমত ও শান্তি বর্ষিত হোক। সমাপ্ত

https://islamqa.info/bn/106527