কৃষি কাজ করা এবং কৃষি সরঞ্জমাদি সংরক্ষণ করাকে হাদীসে হারাম বলা হয়েছে

প্রশ্ন: সহীহ বুখারীতে একটি আবু উমামাহ বাহেলী (رضي الله عنه) থেকে বর্ণিত হয়েছে, তিনি লাঙলের ফাল এবং কৃষি সরঞ্জাম দেখে বললেন, আমি নবী (صلي الله عليه وسلم) কে বলতে শুনেছি, তিনি বলেছেন: لا يدخل هذا بيت قوم الا ادخله الله الذل
“এটা যে ঘরে প্রবেশ করে আল্লাহ সে ঘরে কেবল অপমান প্রবেশ করান ৷”(সহীহ বুখারী, অধ্যায় ৪১: চাষাবাদ পর্ব, অনুচ্ছেদ ২, হাদিস ২৩২১, হাদিস ও পর্বের নম্বর বিন্যাস: মুহাম্মদ বিন হাজ্জ্বাজ)

এই হাদিসের ভিত্তিতে কে কৃষি সরঞ্জামাদি ব্যবহার হারাম সাব্যস্ত হয়? নাকি ঘরে প্রবেশ করানো হারাম? যদি ঘরে না রাখে তবে অন্য কোথাও বা গোডাউনে সংরক্ষণ করা যাবে কি? এবং এগুলো বিক্রির হুকুম কী হবে?

উত্তর:
সহিহ বুখারীর হাদীস:
أَبِي أُمَامَةَ الْبَاهِلِيِّ قَالَ وَرَأَى سِكَّةً وَشَيْئًا مِنْ آلَةِ الْحَرْثِ فَقَالَ سَمِعْتُ النَّبِيَّ صلى الله عليه وسلم يَقُولُ لاَ يَدْخُلُ هَذَا بَيْتَ قَوْمٍ إِلاَّ أَدْخَلَهُ اللهُ الذُّلَّ
আবু উমামাহ্ বাহিলী (রাঃ) হতে বর্ণিত। তিনি বলেন, লাঙ্গলের ফাল এবং কিছু কৃষি সরঞ্জাম দেখে বললেন, আমি নবী সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়াসাল্লামকে বলতে শুনেছি, এটা যে সম্প্রদায়ের ঘরে প্রবেশ করে, আল্লাহ সেখানে অপমান প্রবেশ করান। [সহীহ বুখারী, হা/2321, অধ্যায়ঃ ৪১/ চাষাবাদ (كتاب المزارعة) তাওহীদ পাবলিকেশন]

🔰 *হাদীসটির ব্যাখ্যা:*

আলেমগণ এ হাদিসটির একাধিক ব্যাখ্যা দিয়েছেন। নিম্ন তাদের কিছু বক্তব্য তুলে ধরা হল:

💠 ইমাম বুখারী রহ. এর মতে এ হাদিস দ্বারা উদ্দেশ্য হল, কেউ যদি সব সময় কেবল ক্ষেত-খামার আর কৃষি কাজ-কর্ম নিয়ে ব্যাতিব্যস্ত থাকে এবং এ ক্ষেত্রে শরীয়ত অনুমোদিত সীমা লঙ্ঘন করে তাহলে তা তার জন্য লাঞ্ছনার কারণ হবে। তাই তিনি উক্ত হাদিসের باب বা অনুচ্ছেদে বলেন: “শুধু কৃষি সরঞ্জাম নিয়ে ব্যস্ত থাকার অথবা নির্দেশিত সীমালঙ্ঘন করার পরিণতি সম্পর্কে সতর্কীকরণ।”

কিন্তু প্রয়োজনীয় কৃষি কাজ করা দূষণীয় নয় বরং প্রশংসনীয় ও সওয়াবের কাজ। এ ব্যাপারে বহু হাদিস রয়েছে। যেমন একটি হাদিস হল:
عَنْ أَنَسٍ، عَنِ النَّبِيِّ صلى الله عليه وسلم قَالَ ‏ “‏ مَا مِنْ مُسْلِمٍ يَغْرِسُ غَرْسًا أَوْ يَزْرَعُ زَرْعًا فَيَأْكُلُ مِنْهُ إِنْسَانٌ أَوْ طَيْرٌ أَوْ بَهِيمَةٌ إِلاَّ كَانَتْ لَهُ صَدَقَةٌ ‏”

আনাস (রাঃ) হতে বর্ণিত আছে, নাবী সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়াসাল্লাম বলেছেন: কোন মুসলিম লোক বৃক্ষ রোপণ করলে অথবা কৃষিকাজ করলে এবং তা হতে মানুষ অথবা পশু-পাখি খেয়ে নিলে সেটা তার জন্য দান-খায়রাত হিসেবে বিবেচিত হবে। সুনান আত তিরমিযী [তাহকীককৃত]
হা/1382, অধ্যায়ঃ বিচার কার্য (كتاب الأحكام عن رسول الله ﷺ), হুসাইন আল-মাদানি প্রকাশনী, সনদ সহীহ]

💠 সহীহ বুখারীর ব্যাখ্যা গ্রন্থ ফাতহুল বারীতে ইমাম ইবনে হাজার আসকালানী রহ. বলেন: “এই লাঞ্ছনার দ্বারা উদ্দেশ্য হল, রাষ্ট্রের পক্ষ থেকে ফসলের উপর নির্ধারিত ট্যাক্স। তৎকালীন সময় কোন অঞ্চল বিজিত হলে, জমিনে কৃষিকাজের দায়িত্ব থাকত ঐ অঞ্চলের কাফের জিম্মিদের উপর। এ কারণে সাহাবীগণ তখন সাধারণত: কৃষি কাজে লিপ্ত থাকাকে অপছন্দ করতেন।”
 বি:দ্র: ইসলামের পরিভাষায় জিম্মি বলা হয়, ঐ সকল যুদ্ধ পরাজিত কাফের সম্প্রদায়কে যাদের সাথে বিজয়ী মুসলিম সেনাবাহিনীর সাথে এই চুক্তি হয় যে, তারা রাষ্ট্রীয় কোষাগারে নির্দিষ্ট পরিমাণ যিযিয়া বা ট্যাক্স প্রদান করবে আর এর বিনিময়ে ইসলামী রাষ্ট্র তাদের নিরাপত্তা দিবে।
কোন অমুসলিম অঞ্চল মুসলিমগণ যুদ্ধের মাধ্যমে জয় করলে কাফেরদের জায়গা-জমি তাদেরকেই চাষাবাদের জন্য প্রদান করা হত, তাদের পক্ষ ইসলামী রাষ্ট্রের কোষাগারে যিযিয়া বা ট্যাক্স প্রদানের শর্তে। তাই সাহাবীগণ তখন সাধারণত: কৃষি কাজে লিপ্ত থাকাকে অপছন্দ করতেন।
এ কারণে কৃষি সরঞ্জমাদিকে লাঞ্ছনার উপকরণ বলা হয়েছে। কিন্তু মূলত: কৃষি কাজ বা বাড়ির মধ্যে কৃষি সরঞ্জামাদি সংরক্ষণ করার উদ্দেশ্যে রাখা দূষণীয় নয়।

💠 দাঊদী থেকে বর্ণিত হয়েছে। তিনি বলেন “হাদিসটি ঐ সময়ের জন্য প্রযোজ্য, যখন শত্রু বাহিনী সন্নিকটে চলে আসে আর তখনও কেউ যদি কৃষি কাজ ও এগুলোর সরঞ্জামাদি নিয়ে ব্যতিব্যস্ত থাকে এবং ঘোড়া পরিচালনা ও প্রস্তুত না করে। (এ অবস্থায় এ সব কৃষি সামগ্রী তাদের জন্য লাঞ্ছনার কারণ হবে।)
বরং সে সময় কৃষকদের জন্য করণীয় হল, তারা জিহাদের জন্য ঘোড়া প্রস্তুত করে দিবে আর অন্যরা মুসলিম যোদ্ধাদেরকে প্রয়োজনীয় রসদ-সামগ্রী দ্বারা সাহায্য করবে।” (ফাতহুল বারী)

💠 কোন কোন মুহাদ্দিস বলেন, এ কথার দ্বারা উদ্দেশ্য হল, যখন মানুষ কৃষিকাজকে প্রাধান্য দিবে এবং জিহাদকে ছেড়ে দিবে তখন লাঞ্ছনা-ব্যঞ্জনার শিকার হবে। এ কথা সমর্থনে নিম্নোক্ত হাদিসটি প্রণিধানযোগ্য:
عَنِ ابْنِ عُمَرَ رَضِيَ اللَّهُ عَنْهُمَا قَالَ: سَمِعْتُ رَسُولَ اللَّهِ – صلى الله عليه وسلم – يَقُولُ
«إِذَا تَبَايَعْتُمْ بِالعِينَةِ، وَأَخَذْتُمْ أَذْنَابَ البَقَرِ، وَرَضِيتُمْ بِالزَّرْعِ، وَتَرَكْتُمُ الجِهَادَ، سَلَّطَ اللَّهُ عَلَيْكُمْ ذُلًّا لَا يَنْزِعُهُ حَتَّى تَرْجِعُوا إِلَى دِينِكُمْ»

ইবনু ‘উমর (রাঃ) সূত্র থেকে বর্ণিত, তিনি বলেন, আমি রাসূলুল্লাহ (সাল্লাল্লাহু ‘আলাইহি ওয়া সাল্লাম)-কে বলতে শুনেছিঃ
“যখন তোমরা ঈনা পদ্ধতিতে (*) ব্যবসা করবে, গরুর লেজ আঁকড়ে ধরবে, কৃষিকাজেই সন্তুষ্ট থাকবে এবং জিহাদ ছেড়ে দিবে তখন আল্লাহ তোমাদের উপর লাঞ্ছনা ও অপমান চাপিয়ে দিবেন। তোমরা তোমাদের দ্বীনে ফিরে না আসা পর্যন্ত আল্লাহ তোমাদেরকে এই অপমান থেকে মুক্তি দিবেন না।”

(সুনানে আবু দাউদ, অধ্যায়: ইজারা (ভাড়া ও শ্রম বিক্রয়) , অনুচ্ছেদ-৫৬ ঈনাহ পদ্ধতির লেনদেন, হা/৩৪৬২. সনদ-হাসান)
(*) ঈনাঃ প্রকৃত মূল্যের চেয়ে ধারে অধিক ক্রয়-বিক্রয় করা। যেমন কেউ নির্দিষ্ট সময়ের জন্য দশ টাকায় কিছু বিক্রি করলো এবং ঐ সময় শেষ হওয়ার পর তা আট টাকায় কিনে নিলো।

মোটকথা, কৃষিকাজ করা এবং কৃষি সরঞ্জামাদি বাড়িতে সংরক্ষণ করা, ক্রয়-বিক্রয় করা দূষণীয় নয় যখন তা হালাল ভাবে জীবন-যাপনের মাধ্যম হিসেবে গ্রহণ করা হবে। তবে তখনই দূষণীয় হবে যখন মানুষ শুধু এগুলো নিয়ে ব্যাতি ব্যস্ত থাকবে এবং এ ক্ষেত্রে শরীয়তের সীমালঙ্ঘন করবে। এমনকি জিহাদের ডাক আসলেও তখন সে দিকে ভ্রূক্ষেপ না করে চাষাবাদ, গরু পালন এবং এ সব দুনিয়াবি কর্মে লিপ্ত থাকবে।
আল্লাহ তাআলা দ্বীন ও দুনিয়ার মাঝে সমন্বয় সাধন করে জীবন পরিচালনার তাওফিক দান করুন। আমীন।

উত্তর প্রদানে:
আব্দুল্লাহিল হাদী বিন আব্দুল জলীল মাদানি
দাঈ, জুবাইল দাওয়াহ সেন্টার, সৌদি আরব